মুহাম্মদ আতিকুল ইসলাম :

দেশের আইন ও নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে,যা কিছু হয় তাই দুর্নীতি। যার অর্থ খারাপ অভ্যাস ও ভ্রান্ত নীতি। এটা এমন এক ধরণের লেনদেন যাহা গোপনভাবে এক বা একাধিক ব্যাক্তির মধ্যে সম্পাদিত হয়।এই অবৈধ মরণব্যাধীর ফলে মানবজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। যাহা ব্যাক্তিগত জীবনেও তাঁরা উপলব্ধি করে প্রকৃত পক্ষে।মহান রব বলেন:-মানুষ স্বহস্তে যা কামাই করেছে তার কারণে জলে -স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে যাতে আল্লাহ ওদের আস্বাদন করান ওদের কৃতকর্মের কিছুটা (শাস্তি)যেন ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে (সূরা রোম -৪১) ব্যাখ্যা :-মানুষ স্বভাব ধর্মের ওপর কায়েম থাকেনি-দুনিয়াতে কুফর ও জুলুমের প্রসার লাভ করেছে এবং তার ফলে দেশ-দেশান্তরেও জলে -স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। স্থল ভাগ ও জল ভাগে কোথাও শান্তি ও নিরাপত্তা নেই পৃথিবীকে ফেতনা -ফাসাদ ঘিরে ফেলেছে। সামুদ্রিক যুদ্ধ -বিগ্রহ ও জাহাজ সমূহে ডাকাতি লুটপাটের ফলে সাগর -মহাসাগরেও বিপর্যয়ের ঝড় তুফান অহরহ হচ্ছে। এসব এ জন্য যে আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা মানুষ তার দুস্কর্মের কিছুটা শান্তি দুনিয়াতে ভোগ করুক -পূর্ণ শান্তি তো আখেরাতে হবে :-কিন্তু কিছুটা নমুনা এখানেও দেখা হোক। এতে কিছু লোক ভীত হয়ে সৎ পথে এসে যাওয়ার সম্ভবনা আছে( তাফসীরে ওছমানী)

ঘুষ হচ্ছে দুর্নীতির মূল উৎস এর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান অত্যান্ত কঠোর ও স্পট। ঘুষের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের অর্থ -সম্পদ আত্বসাৎ করে আসছে। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা স্বজন প্রীতির মাধ্যমে যাবতীয় অনৈতিক কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করে যাচ্ছে। ফলে সমাজের দরিদ্র, অসহায় লোকেরা বঞ্চিত, লাঞ্চিত, শোষিত হচ্ছে। ঘুষ আর দুর্নীতি সমাজের নৈতিকতার ভিত্তি ও মানুষের মানবিকতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। দুর্নীতির প্রভাবে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকেরাও নীরবে এর শিকার হচ্ছে। বর্তমান সমাজজীবনে সৎ যোগ্য নীতিবান ধর্মভীরুরাও দুর্নীতির শিকার হয়ে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে।এভাবেই পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে।অথচ অবৈধ উপায়ে হারাম পন্থায় সম্পদ অর্জন এবং ভোগ করা নিষিদ্ধ করে দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলামে মূলনীতি মালা ঘোষিত হয়েছে। মহান রব বলেন:- তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করোনা এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে শুনে অবৈধ পন্থায় আত্বসাৎ করার উদ্দেশ্য বিচারকদের হাতে তোলে দিওনা (সূরা বাকারা-১৮৮)

মানবতার দূত রাসুলুল্লাহ সা.বলেছেন:-যে ব্যক্তি ঘুষ খেলো, ঘুষ দিলো,এবং উভয়ের সমন্বয়ের কাজ করলো তিনজনই সমান অপরাধী (মুসলিম)তাওবা নসিব না হলে জাহান্নাম ছাড়া কোন উপায় নাই। যে সমাজে ও রাস্ট্রে ঘুষ আদান-প্রদান করা হয়,সে সমাজে কখনো শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্টিত হতে পারেনা।মহান রব বলেন:-হে মানব জাতি পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো।আর শয়তানের পদাস্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রুু (সূরা বাকারা-১৬৮) দুর্নীতির অন্যতম শাখা হচ্ছে স্বজনপ্রীতি। এতে সমাজজীবনে অযোগ্য কর্তৃত্ব ও অসৎ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। দেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিনষ্ট করে। স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির ফলে জাতীয় জীবনে নানা রকম অনাস্থা সৃষ্টি ও বিশৃংখলা দেখা দেয়।রাসুলুল্লাহ সা.কঠোরভাবে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধাচরণ করে,একসময় কোরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে। রাসুলুল্লাহ সা.তাহার হস্ত কর্তনের নির্দেশদেন।অাভিজাত্য ও বংশ মর্যদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসুলুল্লাহ সা.এর নিকট তার একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবন যায়দ রা.সুপারিশ করেন।রাসুলুল্লাহ স.তাঁকে বলেন তুমি আল্লাহর দন্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ? অত:পর লোকজনকে আহবান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন হে মানব মন্ডলী! নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্য যে তাদের কোন সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত।আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত,তখন তারা তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ এর কন্যা ফাতিমা ও যদি চুরি করে তবে অবশ্যই তার হস্তকর্তন করে দিতাম। (বোখারীও মুসলিম সূত্র : মিশকাত পৃষ্ঠা ৩১৪)

ইসলামে কোনো সরকারি কর্মকর্তা -কর্মচারীকে ন্যায় পরিশ্রমিকের অতিরিক্ত কোনো উপহার বা উপঢৌকন নিতে নিষেধ করা হয়েছে।কোনো লোভী মানুষকে যখন বেশী পাওয়ার লালসা পেয়ে বসে তখন তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়।এই মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার গুনাহই সবচেয়ে জঘন্য ইসলামের মধ্যে এর ফলে তার সামন্য মানবিকতা যা ছিল তাও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন সে নীতি -নৈতিকতা ও সততার চেয়ে ধন-সম্পদকে প্রধান বিবেচনা করে। যার ফলে সমাজে দুর্নীতি পাগলা ঘোড়ার মতো মাথাচড়া দিয়ে উঠে।

বিশ্বচরাচরের মালিক ও পালনকর্তা মহান আল্লাহর বিধান কোরআন ও হাদীসের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী জাতি-ধর্ম -বর্ণ নির্বেশেষে সবাইকে সক্রিয়ভাবে আন্তরিকতার সাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইসলামের আলোকে অত্যান্ত কঠোর অবস্থান নিতে হবে।ব্যক্তি, পরিবার,সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি বিষয়ক সর্বাত্মক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।যারা দুর্নীতি করে সমাজে আমানতের খেয়ানত করে বা আত্বসাৎ, জবর দখল, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, ধোকাবাজি, ওজনে কম দেওয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অতি মুনাফার লোভে মালের স্টক করা প্রভৃতি ইসলাম পরিপন্থী জঘন্যতম কাজ।
মহান রব বলেন:-কখনো নয়,নিশ্চয় পাপীদের আমলনামা আছে “সিজ্জীনে”আপনি কি জানেন “সিজ্জীন” কি? (সূরা তাত্ফীক -৭-৮) ব্যাখ্যা :-অর্থাৎ সিজ্জীন একটি দফতর যার মধ্যে প্রত্যেক দোযখীর নাম লিখিত আছে। আর বান্দাদের আমল -লেখক ফেরেশতাগণ বদকারদের মৃত্যুর ও আমল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেক ব্যাক্তির আমল পৃথক পৃথক ফর্দের মধ্যে লিখে উক্ত দফতরে দাখিল করেন। এবং উক্ত ফর্দের ওপর অথবা প্রত্যেক দোযখীর নামের ওপর একটি চিন্হ তৈরী করে দেন-যা দেখা মাত্রই জানা যাবে যে,এ ব্যক্তি দোযখী। (তাফসীরে ওছমানী)

সুতরাং আমাদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি হতে বাচঁতে হলে সকল অনিয়ম ও দুর্নীতিকে বর্জন করতে হবে।
পরিশেষে :-বলা যায় যে, ইতোমধ্যে দুর্নীতি বন্ধে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সাথে সাথে এই উদ্যোগ যেন পূর্ণসফলতায় পৌঁছে, সে জন্য সরকার কে আরো জোরদার হওয়ার আহবান করছি। এবং রাস্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে দেশের প্রখ্যাত আলেমদের মাধ্যমে দুর্নীতি বন্ধে কোরআন ও হাদিসের আলোকে দিকনির্দেশনা মূলক নছিহত প্রচার করে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিকতা তথা তাক্ওয়াবান অর্থাৎ খোদাভীতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করা হোক।
লেখক:-গবেষক,সেক্রেটারি,আল-কোরআন ফাউন্ডেশন,পেকুয়া, কক্সবাজার
E-mail :- m.atikulislam2019@gmail.com